দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বৃটিশরাজ ঠিক করে ফেলে ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে৷ সেইমতোই চুক্তি পাকা হয়ে যায় গান্ধি ও আরউইনের মধ্যে৷ গোলটেবিল বৈঠকে তা চূড়ান্ত রূপ পায়৷ গান্ধিজীর উপদেশে ও পরিকল্পনায় ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর নবগঠিত কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লির প্রথম সভা বসে ৷ কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেসের নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় গান্ধিজী যে শুধু কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলীতে যোগদান করেননি তাই–ই নয়, গান্ধিজী কংগ্রেসের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ ক’রে নিজের দর্শন ও শান্তি রক্ষার জন্য সবরমতি আশ্রমে চলে যান৷ গান্ধিজীর অভাবে কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লির অধিবেশন কিন্তু থেমে থাকেনি৷ ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত অনেকগুলি অধিবেশনের মধ্যে দিয়ে ভারতের সংবিধান চূড়ান্ত রূপ পায়৷
সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির সভায় ওই সংবিধান ভারতীয়দের দ্বারা গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর৷ ভারত প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ জানুয়ারী৷ আর সংবিধান ভারত সরকার দ্বারা নোটিফায়েড হয় ১৯৫০ সালের ১০ মে৷ সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির সভায় প্রস্তুত ভারতের নাগরিকদের দ্বারা গৃহীত ভারতের সংবিধান ভারত সরকার প্রথম প্রকাশ করেন ১৯৪৯ সালেই৷
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে গ্রেট বৃটেনের শাসক সম্প্রদায়ের ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে কথাবার্তা সম্পূর্ণ হয়ে যায়৷ ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গোল টেবিল বৈঠকে তা চূড়ান্ত রূপ পায়৷ গান্ধিজীর পরিকল্পনায়, উপদেশে ও ব্যবস্থাপনায় ভারতে তৈরি হয় কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লি৷ ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখে নতুন দিল্লিতে বসে কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লির প্রথম বৈঠক৷ কংগ্রেসের কতিপয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতাদর্শগত বিরোধ হওয়ায় গান্ধিজী শুধু কংগ্রেসই ত্যাগ করেননি, তিনি এমনকি তাঁর হাতে গড়া কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লিতেও যোগদান করেননি৷ গান্ধিজীর অবর্তমানে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ হয়েছিলেন কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লির চেয়ারম্যান৷ প্রায় বছর তিনেক ধরে নানা অধিবেশন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে দিয়ে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে সম্পূর্ণভাবে রচিত হয়ে যায় ভারতের সংবিধান৷ রচিত সংবিধান ক্যালিগ্রাফ করে লিখিয়ে নেওয়া হয় দিল্লির প্রেম বিহারী নারায়ণ রায়জাদাকে দিয়ে৷ প্রেম প্রায় একমাস পরিশ্রম করে ২৫৪ টি কলমের হ্যান্ডেল ও ৩০৩ টি নিব ব্যবহার করে কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে রচিত সংবিধানকে ক্যালিগ্রাফ করে লিখে দেন৷ ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারী সকাল ১১ টায় গণপরিষদের অধিবেশন বসে৷ প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগে প্রায় ২৫৮ জন প্রতিনিধির স্বাক্ষর করতে৷ এর পর ভারতের রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ঐ স্বাক্ষরিত সংবিধানকে অলঙ্কৃত করতে সংবিধান গ্রন্থকে নিয়ে যান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভারত শিল্পী নন্দলালের কাছে৷ নন্দলাল বসু তখন শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের অধ্যক্ষ৷ ১৯৩৫ সাল থেকে কংগ্রেসের প্রায় সকল অধিবেশনের প্রদর্শনী হয়ে এসেছে নন্দলালের তত্বাবধানে৷ ভারতের মর্মবাণী একমাত্র নন্দলালের ছবিতেই ফুটে উঠত৷ গান্ধিজী বলতেন নন্দলাল তাঁর থেকেও বড় দার্শনিক৷ তাঁর ছবিতে গান্ধিজীর দর্শন যত জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠত গান্ধিজী মানুষকে অত প্রাণবন্ত ভাবে বোঝাতে পারতেন না৷ গান্ধি–রবীন্দ্রনাথের ভাব শিষ্য নন্দলাল বসু তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে প্রায় একমাসের পরিশ্রমে সংবিধানগ্রন্থের ইল্যুমিনেশন ও ইলাস্ট্রেশনস্ করে দেন৷ ইলাস্ট্রেশনে ফুটে উঠে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ হাজার বছরের ক্রমান্বয়ী দার্শনিক ব্যাখ্যা৷ ইলাস্ট্রেশনস্ এ যেমন আছে ভারতীয় সভ্যতার আদি নিদর্শন মহেঞ্জোদারো হরপ্পার সিলমোহর, তেমনি আছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বা ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবস্থানের নিদর্শন গান্ধিজীর ডান্ডি বা নোয়াখালি যাত্রার বা দেশের বাইরে গিয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর গৌরবজনক ভূমিকার ছবি৷
১৯৪৯ সালে প্রিন্টেড ইন ইন্ডিয়া বাই দি ম্যানেজার, গভঃ অব্ ইন্ডিয়া প্রেস, নিউ দিল্লি এবং পাবলিশড্ বাই দি ম্যানেজার অব পাবলিকেশনস্, দিল্লির দ্বারা প্রকাশিত ভারতের সংবিধানের ২৫১ পাতার প্রথম ছাপা কপিটির সঙ্গে সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির সভায় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয়দের দ্বারা গৃহীত ও সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির সদস্যদের দ্বারা স্বাক্ষরিত ও সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে নন্দলাল বসুর অলঙ্করণ ইলাস্ট্রেশন ও ইমুলারেশন ভারতবর্ষের মর্মবাণীর দার্শনিক ভিত্তি সহ সংবিধানের আসল কপিটির অনেক কিছুতেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়না৷ সংবিধানের প্রথম ছাপা কপিটি যখন প্রকাশিত হয় তখনও সম্ভবতঃ সংবিধানের মূল খসড়ায় স্বাক্ষরও হয়নি৷এমনকি সংবিধান গ্রন্থটি ইল্যুমিনেশন ও ইলাস্ট্রেশনও হয়নি৷ ১৯৪৯ সালে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ঐ বৎসর ২৬ নভেম্বর ভারতীয়দের দ্বারা গৃহীত ও সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, জহরলাল নেহেরু, ডঃ আম্বেদকার থেকে শুরু করে প্রায় ২৫৮ জন জনপ্রতিনিধির দ্বারা স্বাক্ষরিত আসল সংবিধানটিকে সম্পূর্ণ না করেই প্রায় অসম্পূর্ণ সংবিধান প্রকাশ করেছিলেন৷ ১৯৪৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সংবিধানের ছাপা কপিতে থাকল না জনপ্রতিনিধিদের তালিকা ও স্বাক্ষর, অনুপস্থিত রয়ে গেল জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির ভারতের পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্রের দার্শনিক ব্যাখ্যা মেনে প্রতিভাত বাঙালি শিল্পী গান্ধি – রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য নন্দলাল বসুর তুলির টানের ছবির অলঙ্করণ ও ইলাস্ট্রেশনস্৷ ফলতঃই ভারতীয় নাগরিকদের কাছে সংবিধান রচনা পরিষদের অধিবেশনে ভারতীয়দের দ্বারা গৃহীত সংবিধানে ভারতের পাঁচ হাজার বছরের গণতন্ত্র ও সভ্যতার ইতিহাস ও দর্শনের আসল রূপটিই রয়ে গেল অধরা৷ বলা যেতে পারে অসম্পূর্ণ সংবিধানের ধারাবাহিকতাতেই প্রায় প্রতি বৎসর ভারত সরকারের আইন দপ্তর প্রকাশ করে চলেছেন, সংবিধান গ্রন্থ যার সঙ্গে অনেকাংশেই মিল নাই আসল সংবিধান গ্রন্থটির৷ এবং আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় যখন জানা যায় ১৯৫১ সালের ভারতের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী থেকে আজ পর্যন্ত শতাধিক সংবিধান সংশোধনী হলেও কোন সংশোধনী বা তার একটি শব্দও আন্তর্জাতিক আইন মেনে সংযোজিত হয়নি ভারতের আসল সংবিধান গ্রন্থের মূল ভলিউমের কোনো অংশে৷ এমনকি হয়নি ভলিউম কারেকশনও৷ অথচ এই দেশটি চলছে ওই হুবহু স্বাক্ষর না ছাপা সংবিধান মেনেই৷ আসুন দেখে নেওয়া যাক স্বাক্ষরিত ওই ভারতের মূল সংবিধান গ্রন্থটিতে যাতে ভারতবাসী নিজেদেরকে সমর্পন করেছিল তাতে কি আছে ? কার নির্দেশে কি ভাবেই বা প্রস্তুত হয়েছিল পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের নিয়ম নির্দেশিকা ৷ তার আগে দেখে নেওয়া যাক আসল ওই পবিত্র গ্রন্থের মাপ জোক ৷
২৩১ পাতার সুদৃশ্য অলঙ্কৃত প্রতিটি পরিচ্ছেদের প্রথমে একটি করে ছবি আঁকা যা ওই পরিচ্ছেদের অর্ন্তনিহিত অর্থ প্রকাশ করে৷ বাইশটি পরিচ্ছেদে বাইশটি ছবি বা ইলাস্ট্রেশন্স এর মধ্যে ফুটে উঠেছে ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের পাঁচ হাজার বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস৷ নিঃসন্দেহে ওই পরিকল্পনা ছিল জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির৷ মহাত্মাজীর আজন্ম লালিত দার্শনিক ব্যাখ্যাই প্রতিফলিত হয়েছে ভারতীয়দের দ্বারা গৃহীত ওই ক্যালিওগ্রাফ সংবিধানে৷ অথচ জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি উপস্থিত ছিলেন না কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির কোন অধিবেশনে৷ একথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন জহরলাল নেহেরু সংবিধান প্রস্তুতি কমিটির সভায় –
“There is another person who is absent here and who must be in the minds of many of us today- the great leader of our people, the father of our Nation (applause)-who has been the architect of this Assembly and all, that has gone before it and possibly of much that will follow. He is not here because, in pursuit of his ideals, he is ceaselessly working in a far corner of India. But I have no doubt that his spirit hovers over this place and blesses our undertaking.” …… ‘We are at the end of an era and possibly very soon we shall embark upon a new age; and my mind goes back to the great past India to the 5,000 years of India’s history, from the very dawn of that history which might be considered almost the dawn of human history, till today. All that past crowds around me and exhilarates me and, at the same time, somewhat oppresses me. Am I worthy of that past? When I think also of the future, the greater future I hope, standing on this sword’s edge of the present between this mighty past and the mightier future, I tremble a little and feel overwhelmed by this mighty task. He told we have come here at a strange moment in India’s history.’
লেখক: শ্যামল দাস, এডভোকেট,
আজীবন সদস্য,সুপ্রিম কোর্ট বার এশোসিয়েশন (রেজিস্ট্রাড)
ভারতের সংবিধান রচনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
Posted on June 14, 2025 by Syamal Das
0